ষোড়শ মহাজনপদ বলতে কী বোঝায় ?

জন কথাটির অর্থ উপজাতি বা গোষ্ঠী। অর্থাৎ যে ভৌগোলিক অঞ্চলে কোনো উপজাতি বা গোষ্ঠীর পা বা পদ পড়েছিল সেই ভৌগোলিক এলাকা বা অঞ্চলকে বলা হত জনপদ। মহাজনপদ হল অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও বৃহত্তর আয়তন যুক্ত রাজ্য। পাণিনির মতে এ সময় উত্তর ভারতে ৩০টি জনপদ বা রাজ্য ছিল। বৌদ্ধ অঙ্গুত্তরনিকায় ও জৈন ভগবতীসুত্র দুটি গ্রন্থে ষােলােটি রাজ্যের নাম উল্লিখিত থাকলেও, নামগুলির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। এই ষোলটি মহাজনপদকে একত্রে বলা হত 'ষােড়শ মহাজনপদ'। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনা থেকে মগধের উথান পর্যন্ত সময়কে ষােড়শ মহাজননপদের যুগ বলে অভিহিত করা হয়।

(১)কাশী: বর্তমান উত্তর প্রদেশের বারাণসী অঞ্চল নিয়ে গঠিত কাশী ছিল ষােড়শ মহাজনপদ যুগের প্রথমদিকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্য। কাশী রাজ্যর রাজধানী ছিল বারাণসী। বরুণা ও অসি নামে গঙ্গার দুই শাখানদী কাশী নগরটিক বেষ্টন করে ছিল বলে এর নাম বারাণসী। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বারাণসী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাতক থেকে কোশল ও অঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে কাশীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানা যায়। গৌতম বুদ্ধের সময় কাশী রাজ্যের পতন ঘটে এবং কোশল তা জয় করে।

(২) কোশল: বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল(অযোধ্যা) নিয়ে গঠিত কোশল ছিল একটি বৃহৎ রাজ্য। এর রাজধানী ছিল শ্রাবস্তী। কাশী রাজ্যের পতনের পর কোশল আর্যাবর্তে নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। মগধ রাজ্যের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত কোশল ছিল উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তি। মহাভারত - খ্যাত বিখ্যাত ইক্ষাকু বংশের মহাকোশল এখানে রাজত্ব করতেন। তিনি তার কন্যা কোশলদেবীর সঙ্গে মগধরাজ বিম্বিসারের বিবাহ দেন। কোশল-রাজ প্রসেনজিৎ বুদ্ধর সমসাময়িক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোশল রাজ্য মগধের অধিকারভুক্ত হয়।

(৩) অঙ্গ: বর্তমান বিহারের ভাগলপুর ও মুঙ্গের জেলা নিয়ে অঙ্গ রাজ্য গঠিত ছিল। মহাভারতের কর্ণ ছিলেন এই রাজ্যের অধিপতি।গঙ্গা ও চম্পা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত চম্পা নগরী ছিল অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী। চম্পা নগরী ছিল বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র ।চম্পা নগরীর পূর্ব নাম ছিল মালিনী। মগধ রাজ বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্যটি গ্রাস করেন।

(৪) মগধ: বর্তমান বিহারের গয়া, পাটনা এবং সাহাবাদের কিছু অংশ নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত। গঙ্গা, শোন ও চম্পা নদী পরিবেষ্টিত মগধ রাজ্যের প্রথম রাজধানী ছিল গিরিব্রজ। পরবর্তীকালে যথাক্রমে রাজগৃহ ও পাটলিপুত্রে মগধের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধদেবের সমসাময়িক হর্ষঙ্ক বংশীয় রাজা বিম্বিসার মগধের সিংহাসনে বসেন। বিম্বিসারের আমল থেকেই মগধ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মগধকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।

(৫) বৃজি: গঙ্গা নদীর উত্তর ভাগ থেকে নেপাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ নিয়ে ব্রিজি প্রজাতন্ত্র গঠিত ছিল। রিস ডেভিডস ও কানিংহাম এর এর মতে আটটি উপজাতি গােষ্ঠীর মানুষ যৌথভাবে এই প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর মধ্যে শাক্য, লিচ্ছবি, জ্ঞাত্বক, বিদেহ ও বৃজি ছিল বিশেষ উল্লেখযােগ্য। বৃজির অন্তর্গত শাক্য বংশে ভগবান বুদ্ধদেব এবং জ্ঞাতৃক কুলে মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন। বৈশালী (বর্তমান মজঃফরপুর জেলা) ছিল বৃজি রাজ্যের রাজধানী ।

(৬) মল্ল বা মালব: বৃজি রাজ্যের উত্তরে, সম্ভবত উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলায় মল্ল রাজ্য অবস্থিত ছিল। বৃজি রাজ্যের মতাে এটিও ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাজ্য। এই রাজ্যটি দুই অংশে বিভক্ত ছিল এবং মল্ল বা মালব রাজ্যের রাজধানী ছিল কুশীনগর ও পাবা। রাজ্যটির দুই অংশেই বুদ্ধদেবের প্রচুর শিষ্য ছিল। বুদ্ধদেব কুশীনগরে দেহরক্ষা করেন। মহাবীর পাবা নগরীতে দেহরক্ষা করেন।

(৭) চেদি: চেদি হল মহাভারত এবং তারও আগের প্রাচীন রাজ্যে। যমুনা নদীর কাছ বর্তমান বুন্দেলখণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে চেদি রাজ্যটি গঠিত ছিল। চেদি রাজ্যের রাজধানী ছিল শুকতিমতী (বর্তমান উত্তর প্রদেশের বান্দা)। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে চেদি বংশের একটি শাখা কলিঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। পরে মৎস রাজ্য চেদির অন্তর্ভুক্ত হয়।

(৮) বৎস বা বংশ: বর্তমান উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের কাছে গঙ্গার দক্ষিণ তীরে বৎস রাজ্যটি অবস্থিত। বৎস রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রাচীন কৌশাম্বী নগরী (বর্তমান কোশাম)। বংশ রাজ্যটি কৃষিতে খুৰ উন্নত ছিল। তুলা এবং তুলাজাত বস্ত্র উৎপাদন ছিল বংশ রাজ্যের প্রধান শিল্প। বংশ রাজ উদয়ন প্রাচীন ভারতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মহাকবি ভাস এর কল্পবাসবদত্তা এবং শ্রীহর্যের রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা—এই তিনটি নাটকের নায়ক হলেন উদয়ন। উদয়ন গৌতম বুদ্ধ, মগধরাজ বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক ছিলেন। কথাসরিৎসাগর-এ উদয়নের দিগ্বিজয়ের বর্ণনা আছে।

(৯) কুরু: দিল্লি ও তার সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে কুরু রাজ্য গঠিত ছিল। কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপপ্রস্থ। মহাভারতের যুগেও কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। হস্তিনাপুর ছিল কুরু রাজ্যের অন্যতম প্রধান নগর। পালি গ্রন্থ অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যুধিষ্ঠিরের বংশধররা এখানে রাজত্ব করতেন। পরবর্তীকালে কুরু রাজ্য মগধের অধিকারে চলে যায়।

(১০) পাঞ্চাল: বর্তমান রােহিলখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা - যমুনা দোয়াবের কিছু অংশ নিয়ে পাঞ্চাল রাজ্যটি গঠিত ছিল। জাতক, মহাভারত ও দিব্যবদান থেকে জানা যায় যে, গঙ্গা নদী পাঞ্চাল রাজ্যটিকে উত্তর পাঞ্চল ও দক্ষিণ পাঞ্চাল নামে দুটি অংশে বিভক্ত করেছে। উত্তর পাঞ্চলের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য। বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যে, উত্তর পঞ্চালের অধিকার নিয়ে প্রাচীন যুগে কুরু ও পাঞ্চাল রাজ্যের মধ্য সংঘর্ষ হয়।

(১১) মৎস্য: বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর, ভরতপুর ও আলােয়ার নিয়ে মৎস্য রাজ্য গঠিত ছিল। মহাভারতের খ্যাতিমান বিরাট রাজা এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার নাম অনুসারে মৎস্য রাজ্যের রাজধানীর নাম হয় বিরাটনগর (বর্তমানের বৈরাট)।

(১২) শূরসেন: পাঞ্চালের পাশে যমুনা নদীর তীরে শূরসেন রাজ্যে অবস্থিত ছিল। শূরসেন রাজ্যের রাজধানী ছিল মথুরা। মহাভারত ও পুরাণ অনুসারে যদু বা যাদব বংশীয় রাজারা এখানে রাজত্ব করত। খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতকে মেগাস্থিনিস এখানে হেরাক্লেল বা কৃষ্ণের উপাসনা কেন্দ্র দেখেছিলেন। শূরসেনের রাজা অবন্তীপুত্র ছিলেন বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য।

(১৩) অস্মক: দক্ষিণ ভারতে গােদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত অস্মক রাজ্যের রাজধানী ছিল পোটালি, পোটান বা পোদান। মহাভারতের বর্ণনা অনুসারে অম্মক নামে জনৈক রাজর্ষি পােদান নগরীর পত্তন করেন। বায়ুপুরাণে অস্মকের রাজাদের ইক্ষাকু বংশীয় বলা হয়েছে।
(১৪) অবন্তী: মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে অবন্তী রাজ্যে গঠিত। বেত্রবতী নদী এই রাজ্যেকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করেছে। উত্তরাংশের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী এবং দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল মহিস্মতি (বর্তমানে মহেশ্বর)। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের সময় এর অধিপতি ছিলেন প্রদ্যোৎ। তাকে "চণ্ড প্রদ্যোৎ" বলা হত। তিনি আর্যাবর্তে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত অবন্তী রাজ্য মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(১৫) গান্ধার: তক্ষশিলা (বর্তমান রাওয়ালপিণ্ডি) ও কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে সমৃদ্ধশালা গান্ধার রাজ্য গঠিত মহাভারতে এর উল্লেখ আছে এবং ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারী ছিলেন এই রাজ্যের রাজকন্যা। গান্ধার রাজ্যের রাজধানী তক্ষশিলা ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র এবং বাণিজ্যস্থল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে পারসিক সম্রাট দরায়ুস গান্ধার রাজ্য জয় করেন।

(১৬) কম্বােজ: উত্তর - পশ্চিম ভারতে গান্ধার রাজ্যের কাছেই ছিল কম্বােজ রাজ্যে। কম্বােজ রাজ্যের রাজধানী ছিল রাজপুর। মহাভারতে কম্বােজের উল্লেখ আছে। আর্যরা ভারতে প্রবেশের সময়ে কম্বােজে বসবাস করে। আর্য সংস্কৃতি গঙ্গা - যমুনা অঞ্চলে বিস্তৃত হলে কম্বােজের গুরুত্ব কমে যায়।

ষোড়শ মহাজনপদের বৈশিষ্ট্য

(১) ষোলােটি মহাজনপদের অধিকাংশই ছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্য ভারতে। সুদুর দক্ষিণ অঞ্চলে কোনও মহাজনপদ ছিল না। দক্ষিণ ভারতে একটি মাত্র আর্য মহাজনপদ ছিল — অম্মক।
(২) অধিকাংশ মহাজনপদ রাজতন্ত্র প্রচলিত শাসনব্যবস্থা হলেও বৃজি ও মল্ল ছিল প্রজাতান্ত্রিক ।
(৩)রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের জন্য রাজ্যগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই থাকতো । ক্রমে চারটি রাজ্য (মগধ, কোশল, অবন্তি ও বৎস) অপর রাজ্য গুলিকে গ্রাস করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে । তারপর সাম্রাজ্য গঠনের জন্য ঐ চারটি রাজ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয় । অবশেষে মগধ এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ভারতে প্রথম একটি ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপন করে ।